লক্ষ কর—তাহলে দেখবে যে, এই পাঁচ বছরে দুই-একজন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। আবার কারো কোনো পারিবারিক সদস্য মারা গেছে, কেউবা চাকরি বা বিয়ের কারণে অন্যত্র চলে গেছে। আবার শহরে অস্থায়ী/কাঁচা বসতিতে অধিকসংখ্যক শিশু দেখা যায়। নারী-পুরুষও এসব অঞ্চলে অধিক।
এই যে চারপাশের জনসংখ্যার আপাত বৃদ্ধি, কমে যাওয়া এই দুই-এর পার্থক্য থেকে প্রকৃত জনসংখ্যা বৃদ্ধি বের করা যায়। জনসংখ্যার পরিবর্তন এভাবেই হয়ে চলেছে।
তাহলে দেখতে পাচ্ছি যে, জনসংখ্যা একটি সক্রিয় পরিবর্তনশীল উপাদান। জনসংখ্যার এই পরিবর্তন ঘটছে জন্ম, মৃত্যু ও অভিবাসনের কারণে। এগুলোকে আমরা জনসংখ্যার পরিবর্তন প্রক্রিয়ার নিয়ামক বলতে পারি এই নিয়ামকগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে কোনো সমাজ তথা দেশের জনমিতিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়ে থাকে। যার প্রভাব দেখা যায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও।
জন্মহার (Birth Rate)
স্বাভাবিক জন্মহার নারীদের সন্তান ধারণের সামর্থ্য নির্দেশ করে। তবে কোনো নির্দিষ্ট এক বছরের প্রতি হাজার নারীর সন্তান জন্মদানের মোট সংখ্যাকে সাধারণ জন্মহার বলে। সাধারণত ১৫-৪৫ অথবা ১৫-৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত নারীদের প্রজনন ক্ষমতা (Fertility) থাকে। কোনো দেশের বিশেষ কোনো বছরের জন্মিত সন্তানের সংখ্যাকে উক্ত বছরের গণনাকৃত প্রজননক্ষম নারীর মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে সাধারণ জন্মহার নির্ণয় করা হয়।
এ বিষয়টিকে নিম্নোক্তভাবে দেখানো যেতে পারে।
সাধারণ জন্মহার =নির্দিষ্ট বছরে জন্মিত সন্তান/ নির্দিষ্ট বছরের প্রজননক্ষম নারীর সংখ্যা
স্থূল জন্মহার (Crude Birth Rate)
সাধারণ জন্মহারের চেয়ে স্থূল জন্মহার বহুল প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। এই পদ্ধতি হাজারে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কোনো বছরে জন্মিত সন্তানের মোট সংখ্যাকে উক্ত বছরের মধ্যকালীন মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে স্থূল জন্মহার নির্ণয় করা হয়। একে নিম্নোক্তরূপে দেখানো যেতে পারে ।
স্থূল জন্মহার= কোনো বছরের জন্মিত সন্তানের মোট সংখ্যা / বছরের মধ্যকালীন মোট জনসংখ্যা x ১০০০০
কোনো একটি স্থান বা দেশের মোট জনসংখ্যা এবং ঐ বছরে জন্মিত সন্তান ও জনসংখ্যা জানা থাকলে স্থূল জন্মহার বের করা সহজ। পৃথিবীর বিভিন্ন জনসংখ্যার মধ্যে প্রজননশীলতার ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। একেক দেশের জন্মহার একেক রকমের। এর কারণ হিসেবে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভিন্নতা প্রধান। সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়াবলির প্রভাবেই জন্মহারের ভিন্নতা দেখা যায়।
১। বৈবাহিক অবস্থাগত বৈশিষ্ট্য : বিবাহের বয়স, বহুবিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ প্রভৃতি কারণ জন্মহার কম
বা বেশির উপর প্রভাব ফেলে।
২। শিক্ষা : সাধারণ শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেলে প্রজননশীলতা হ্রাস পায় এবং শিক্ষার মান ও হার কম হলে : প্রজননশীলতা বেশি হয়।
৩। পেশা : সাধারণভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত কর্মী এবং শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার বেশি হতে দেখা যায়। অন্যদিকে শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী প্রভৃতি পেশাদার শ্রেণি এবং প্রশাসক, ব্যবস্থাপক ও চাকরিজীবীদের মধ্যে জন্মহার কম দেখা যায় ।
৪। গ্রাম-শহর আবাসিকতা : গ্রাম এলাকায় সাধারণত জন্মহার বেশি এবং শহর এলাকায় জন্মহার কম দেখা
যায়। তবে এই উপাদানটি আবার শিক্ষা ও পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত।
মানব জন্মহারের তারতম্য একটি সামাজিক বিষয়। সমাজ, ব্যক্তি-জীবনের বহুবিধ বিষয়, বিশেষ করে সামাজিক অবস্থান, সামাজিক ভূমিকা, ভৌগোলিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, বৈবাহিক ধারা, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন, সমাজবৈশিষ্ট্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয় মানব প্রজননশীলতা তথা জন্মহারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মৃত্যুহার (Death Rate)
মানুষ মরণশীল। মরণশীলতা জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকেই শুধু প্রভাবিত করে না, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করে থাকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিমাপ করা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য মৃত্যুহার জানা বিশেষ প্রয়োজন।
স্থূল মৃত্যুহার (Crude Death Rate)
স্থূল মৃত্যুহার মরণশীলতা (Mortality) পরিমাপের বহুল প্রচলিত গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। নির্দিষ্ট কোনো বছরে মৃত্যুবরণকারীদের মোট সংখ্যাকে উক্ত বছরের মধ্যকালীন মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে স্থূল মৃত্যুহার নির্ণয় করা হয়।
স্থূল মৃত্যুহার= কোনো বছরে মৃত্যুবরণকারী মোট সংখ্যা/ বছরের মধ্যকালীন মোট জনসংখ্যা x ১০০০
কোনো স্থান বা দেশের মৃতের সংখ্যা এবং মোট জনসংখ্যার তথ্য পাওয়া গেলে স্থূল মৃত্যুহার নির্ণয় করা যায়। তবে মৃত্যুহার নির্ণয়ের জন্য, বয়স-নির্দিষ্ট মৃত্যুহার (Age-specific death rate) গুরুত্বপূর্ণ। যা বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন সংখ্যার মৃত্যুহার নির্দেশ করে, ফলে এই হার থেকে বার্ধক্য ও অকালমৃত্যু প্রভৃতি বোঝা যায়।
পরিণত বয়সে সামান্য অসুখবিসুখ বা আঘাতেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। একে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে। আবার অনেক সময় পরিণত বয়সের পূর্বেই মারা যায়। একে অকাল বা অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে। মৃত্যুহারের পার্থক্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
১। প্রাকৃতিক দুর্যোগ : ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদি অস্বাভাবিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
২। যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা : যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। কুয়েত, আফগানিস্তান, ইরাক যুদ্ধে দেখা যায় তখন ঐ সব দেশে মৃত্যুহার অনেক বেশি ছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক শহিদ হয়।
৩। রোগ ও দুর্ঘটনা : সংক্রামক, শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগ, ক্যান্সার, রক্ত সঞ্চালন সংক্রান্ত রোগ, আঘাত বা দুর্ঘটনা প্রভৃতির কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। অঞ্চলভেদে মরণশীলতার পার্থক্য রয়েছে। অনুন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুহার অনেক বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃত্যুহার কিছুটা কমে এসেছে এবং উন্নত দেশগুলোতে স্বাভাবিক মৃত্যুহার রয়েছে। আবার
নারী-পুরুষের মৃত্যুহারের পার্থক্য দেখা যায়। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রজননকালীন নারীদের
মৃত্যুহার বেশি পরিলক্ষিত হয়। আবার অনুন্নত দেশগুলোতে শিশু মৃত্যুহারও বেশি দেখা যায়।